মানুষের মধ্যে আল্লহর মালিকানার বাহিরে কোন কিছু নাই। মানুষের জান মাল সহ সব কিছুই আল্লাহর মালিকানায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন একটি জিনিস আছে, যা আল্লাহ পুরোপুরি মানুষের হাতে সোদর্প করে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে তার ইখতিয়ার অর্থাৎ স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। মানুষের এতোটুকুই স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি ছাড়াই সে নিজেই নিজের সত্ত্বার ও নিজের প্রতিটি জিনিসের উপর আল্লাহর মালিকানা ইচ্ছা করলে স্বীকার করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে নিজেই মালিক হয়ে যেতে পারে, এবং নিজেই এ কথা মনে করতে পারে যে, সে আল্লাহর থেকে বেপরোয়া হয়ে নিজের ইখতিয়ার তথা স্বাধীন কর্ম ক্ষমতার সীমানার মধ্যে নিজের ইচ্ছমতো কাজ করার অধিকার রাখে।
মানুষের ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা মূলত আল্লাহর দেয়া আমানত। এই স্বাধীনতার মালিক মানুষ নয়। তিনি যা আমানত হিসাবে মানুষের নিকট সোদর্প করেছেন এবং যে ব্যপারে বিশ্বস্ত থাকার বা অবিশ্বস্ত হবার স্বাধীনতা তিনি মানুষকে দিয়ে রেখেছেন। সে ব্যাপারে তিনি মানুষের কাছে দাবি করেন আমার জিনিসকে তুমি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে (বাধ্য হয়ে নয়) আমার জিনিস বলে মেনে নাও এবং সারা জীবন স্বাধীন মালিকের মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নয়, বরং আমানতদার হিসাবে তা ব্যবহার করার বিষয়টি গ্রহণ করে নাও। এই সাথে খেয়ানত করার যে স্বাধীনতা তোমাকে দিয়েছি তা তুমি নিজেই প্রত্যাহার করো। এ ভাবে যদি তুমি দুনিয়ার বর্তমান অস্থায়ী জীবনে নিজের স্বাধীনতাকে (যা তোমার অর্জিত নয় বরং আমার দেয়া) আমার নিকট বিক্রি করে দাও, তা হলে আমি পরবর্তী চিরন্তন জীবনে এর মূল্য জান্নাতের আকারে তোমাকে দান করব। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কেনা-বেচার এ চুক্তি সম্পাদন করে- সে হলো মুমিন। ঈমান আসলে এ কেনা-বেচার আর এক নাম। আর যে ব্যক্তি এটা অস্বীকার করবে অথবা অঙ্গীকার করার পরও এমন আচরন করবে যা কেবল মাত্র কেনা-বেচা না করায় অবস্থায় করা যেতে পারে সে হলো কাফের। এ কেনা-বেচাকে পাশ কাটিয়ে চলার পরিভাষিক নাম কুফুরী। আল্লাহ তায়ালার ঘোষনা :
”প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইঞ্জিন ও কুরআনে (জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পুরণকারী আর কে আছে ? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা-বেচা করছো সেজন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” (সুরা : তওবা -১১১)
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মানুষের জান মালসহ সব কিছুর মালিক আল্লাহ, মানুষের শুধু নিজের বলতে আছে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তথা সিদ্ধান্ত গ্রহনের স্বাধীনতা। আল্লাহ এই স্বাধীনতাটুকু ক্রয় করে নিতে চান। কেউ যদি সেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এই ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা বিক্রয় না করে তা হলে আল্লাহ ক্রয় করবে কিভাবে। জোর করে তা কেনা যায় না। তাছাড়া উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ যা বলেছেন, তা হলো তিনি মুমিনদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন। আল্লাহ এ কথা বলেনি যে, মুমিনেরা তাদের জান-মাল তাঁর কাছে বিক্রয় করেছে। মালের মালিক যদি তার মাল নিজ ইচ্ছায় বিক্রয় না করে তা হলে সে মাল কেউ খরিদ করতে পারে কি ? সব মুমিনই আল্লাহর নিকট জান ও মাল বিক্রয় করে না। আগেই উলে¬খ করেছি যারা বিক্রয় করে তারা সত্যিকার মুমিন। তাই উলে¬খিত আয়াতে আল্লাহ এ কথাই বলতে চেয়েছেন যে যারা নিজ ইচ্ছায় তাদের জান-মাল বিক্রয় করেছে তাদের কাছ থেকেই তিনি কিনেছেন। অর্থাৎ যাদের জান-মাল তিনি কিনেছেন, যারা সন্তুষ্ট চিত্তেই বেঁচতে রাজী হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জোর করে কেনা হয়নি বা তাদেরকে বেচতে বাধ্য করা হয় নি। কোন জিনিস ক্রয় করলে বিক্রেতাকে দাম অবশ্যই দিয়ে দিতে হয়। তা না হলে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয় না। আল্লাহ মুমিনদের জান-মাল ক্রয় করার সাথে সাথেই দামের কথা উলে¬খ করেছেন। যে দাম তিনি দিতে চান তা দুনিয়ার কোন জিনিস নয়। তিনি এতো বিরাট মূল্য দিতে চান যা দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যায় না। মুমিনের জান-মালের বদলে বেহেশ্ত দেয়ার কথা ঘোষনা করেছেন। যেহেতু বেহেশ্ত দুনিয়ার জীবনে পাওয়ার উপায় নেই, সেহেতু এখানে নগদ দাম পরিশোধ করাও সম্ভব নয়। অর্থাৎ আল্লাহপাক বাকীতেই মুমিনের জান-মাল কিনে নিয়েছেন। আল্লাহ নগদ দাম দিচ্ছেন না বলে মুমিনের জান ও মাল বিক্রয় করার সাথে সাথেই তিনি নিয়ে নেন না, বরং মুমিনের জান-মাল তার কাছেই আমানত রাখেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাক বলতে চান যে, হে মুমিন তোমার জান-মাল আমার কাছে বিক্রয় করেছ বলে তুমি যে দাবী করছ তা তোমাকে বাস্তবে প্রমান করে দেখাতে হবে। তোমার জান ও মাল তোমার মালিকানায় নেই। তোমার বাকী জীবনে এ জান ও মাল যদি সম্পূর্ণরুপে আমার মর্জিমত ব্যবহার কর তাহলে আমি স্বীকার করব যে তুমি তা সত্যিই আমার কাছে বিক্রি করেছ। এ প্রমান দিতে পারলে মৃত্যূর পরপরে এর দাম হিসাবে বেহেশ্ত অবশ্যই পাবে।
আল্লাহর নিকট জান-মাল বিক্রয় করা মানে যাবতীয় মানসিক,দৈহিক ও বস্তুগত শক্তি-সামর্থ এবং সময় সম্পদ ও শ্রম আল্লাহর অনুগত্যের অধীনে ব্যবহার করার ওয়াদায় আবদ্ধ হওয়া।এ ওয়াদা এমন ব্যাপক যে ইচ্ছাশক্তি,চিন্তাশক্তি, মনশক্তি এবং বুদ্ধি-বৃত্তিকে ও আল্লাহর মর্জির অধীন করা বুঝায়। এরূপ পূর্নাঙ্গ দাবী পূরণ করতে হলে আল্লাহর সাথে গোপন চুক্তিবদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট নয়। মানুষ যেভাবে শয়তানের ওয়াস ওয়াস নাফসের ধোকা দুনিয়ার মোহ, অন্য মানুষের প্ররোচনা ইত্যাদি দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে, তাতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ অনুগত্য করা বাস্তবে সম্ভব নয়। এ কারনে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) দ্বীনী দাওয়াত যারা কবুল করেছেন তাদেরকে রাসূলের (সাঃ) নেতৃত্বে মেনে জামায়ত বদ্ধ হওয়ার তাগিদ ও আল্লাহ দিয়েছেন। এ জাতীয় সাংগঠনিক বন্ধন ছাড়া আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের পথে অগনিত দুর করা সম্ভব নয়। যারা সাংগঠনিক শৃংখলা কবুল করে রাসুলের (সাঃ) জামায়াতে শরীক হতে রাজী হয়েছেন তারা আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের উদ্দেশ্যে সংগঠনের নির্দেশ পালন করতে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছেন, যাতে সকল প্রকার ধোকা থেকে বেঁচে থাকতে পারে। ইসলামী জামায়াতের আনুগত্যের মাধ্যমেই আল্লাহর আনুগত্য বাস্তবে সহজ ও সম্ভব হয়। জামায়াতের আনুগত্যের এ শপথই ইসলামী পরিভাষায় বাইয়াত নামে নামে পরিচিত। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সঃ) এর নিকট যে বাইয়াত হন তা এ আনুগত্যের শপথ। আল্লাহ তায়ালার ঘোষনা :
”হে রাসূল ! যে সব লোক আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহর কুদরতের হাত ছিল।”( ফাতহ ;১০)
”হে রাসূল ! আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নীচে আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল। ”(সুরা: ফাতহ ;১৮)
” যে ব্যাক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেলো সে জাহিলিয়াতের মৃত্যূবরণ করল। ”মুসলিম’
এ সব ক’টি আয়াত ও হাদীসে বাইয়াতের সারমর্ম হলো মুমিনের জান-মাল, ইচ্ছা-বাসনা অর্থাৎ তার পূর্ন সত্তাকে আল্লাহর মর্জির নিকট সমর্পন করা। এটাই ইসলাম কবুলের মর্ম কথা। ইসলাম শব্দের অর্থ আতœ সমর্পন করা, নত হওয়া, আনুগত্য স্বীকার করা, নিজের ইচ্ছাকে কারো নিকট সোদর্প করে দেয়া। আল কুরআন শুধু ’ইসলাম, বলেনি তার সাথে আলিফ লাম যোগ করে ’আল ইসলাম, বলেছে ; এটা কুরআনের একটি পরিভাষা। অতএব এই বিশিষ্ট পরিভাষা শব্দের অর্থ হলো আল্লাহর সম্মুখে নত হওয়া, তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা, তাঁর নিকট নিজের যাবতীয় স্বাধীনতা / আজাদী পরিত্যাগ করা এবং নিজকে সম্পূর্ণ ভাবে তাঁরই নিকট সমর্পণ করে দেয়া।
প্রিয় পাঠক ! মানুষের নিজের বলতে আছে কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহনের স্বাধীনতাটুকুই । আমি সূখী হব নাকি কষ্টে থাকব সে সিদ্ধান্তের ভার এবং দায়িত্ব আমার। আর কিছুই আমার নয়। আত্বতসমর্পন মানে হলো এই স্বাধীনতাকে ভোগ না করে তার উৎসের কাছে ফেরত দেয়া। তখন ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছ-অনিচ্ছা-আমিত্ব-সূখ-দুঃখ কিছুই থাকে না। এরূপ ব্যক্তিই আল্লাহর প্রকৃত গোলাম। তিনি আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে কেবল প্রেমের গোলামি করছেন। মানুষের উচিৎ আল্লাহ প্রদত্ত এই ক্ষমতা নিজের মত করে ব্যবহার না করা ।
আল্লাহর প্রকৃত গোলামেরা আল্লাহর প্রদত্ত এই আমানত আল্লাহর নিকট ফেরত দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছার গোলামে পরিণত হয়। অর্থ্যাৎ আল্লাহ প্রদত্ত নিজের এই ইচ্ছাশক্তির সাময়িক স্বাধীনতা আল্লাহর নিকট বিক্রি করে আল্লাহর নিকট হইতে অনন্ত কালের স্বাধীনতা ক্রয় করে নেন। তারা তাদের আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা দিয়ে তারই নির্ধারিত কানুন মেনে চলবার পথই স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে। তারা হয়েছে পরিপূর্ণ মুসলিম, তাদের ইসলাম হয়েছে পূর্নাঙ্গ। তাদের পরিপূর্ন জীবনই হয়েছে পূর্ন সত্যাশ্রয়ী। সমগ্র সৃষ্টির সাথে তাদের মিতালী। কারণ সৃষ্টির সকল পদার্থ যার দাসত্ব করে যাচ্ছে, তারাও করছে তাঁরই দাসত্ব। দুনিয়ার বুকে তারা হচ্ছে আল্লাহর খলিফা (প্রতিনিধি) সারা দুনিয়া এখন তাদের এবং তারা হচ্ছে আল্লাহর।
লেখক : তারেক বিন হাম্জা